বাংলাদেশ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে

 

ব্যক্তির পরিবর্তে দলের মোট ভোটপ্রাপ্তির ভিত্তিতে সংসদে আসন নির্ধারিত হবে। ফলে, একটি দল প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। সামান্য কিছু ভোটের হেরফেরে সংসদে আসন সংখ্যা নিয়ে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হবে না। কোনো দল ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েও সংসদে মাত্র ৬২টি আসন বা ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন পাওয়ার মত পরিস্থিতি আর হবে না।

অর্থ ও পেশিশক্তি বা দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হবে। নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবসহ নানা অনিয়মও কমে আসবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও এই ব্যবস্থার পক্ষে দাবী জানিয়েছে।

এই দাবি পূরণে অধিকাংশেরই চাওয়া হলো বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির পরিবর্তে ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (পিআর) বা ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা চালু করা।

দাবিটি নতুন নয়। এক যুগেরও বেশি সময় আগে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে সিপিবির লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটানোর জন্য বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এর একটি প্রধান পদক্ষেপ হবে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন।

এ দাবি এখন বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি চালুর ওপর জোর দিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পদত্যাগের সময় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর বিদায়ী ব্রিফিংয়ে ভবিষ্যতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের বৈচিত্র্যের কারণে দলভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে।’

সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত করতে এবং জুলাই অভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

এই কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, যিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছেন। তিনিও প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতির সমর্থক। গত ২৯ আগস্ট ড. মজুমদারের সংগঠন ‘সুজন’ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন।

এর আগে, ২৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ: দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা’ শিরোনামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) রাষ্ট্রকাঠামোয় প্রয়োজনীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ৯টি কৌশলগত সুপারিশ তুলে ধরে। এর অন্যতম সুপারিশ ছিল সংসদ নির্বাচনে পিআর ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি।

এই পদ্ধতিতে ভোটাররা ব্যক্তির পরিবর্তে দলকে ভোট দেন, এবং দলের ভোটপ্রাপ্তির হারের ভিত্তিতে কতটি আসন পাবে তা নির্ধারিত হয়। ইউরোপের প্রায় সব দেশ এবং পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ বিশ্বের ৯৭টিরও বেশি দেশে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে।

২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মোট ভোটের ৪০.৮৬ শতাংশ পেয়ে ১৯৩টি আসন পেয়েছিল, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ৪০.২১ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ৬২টি আসন পায়। কিন্তু দেশে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির বদলে যদি প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতি চালু থাকত, তাহলে ফল ভিন্ন হতে পারত। সেই নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি থাকলে বিএনপি প্রায় ১২২টি এবং আওয়ামী লীগ অন্তত ১২০টি আসন পেত।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে আসনপ্রাপ্তিতে সামঞ্জস্য ছিল না। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০টি আসন পেলেও, বিএনপি ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৩০টি আসন পায়। পিআর পদ্ধতি থাকলে বিএনপি অন্তত ৫৭টি আসন পেত।

এ বিষয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। অনেকের মতে, পিআর পদ্ধতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতে কমিশন থেকে সুপারিশ দেওয়া হবে। কমিশনের প্রধান হিসেবে আমি ব্যক্তিগত মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকব।’

২৮ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের লক্ষ্যে ৯টি কৌশলগত সুপারিশ তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সংসদ নির্বাচনে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ব্যবস্থা চালু এবং নির্বাচনের জন্য দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব।

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদও মনে করেন, সংসদে সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতি চালু হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। সম্প্রতি তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে, ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট পদ্ধতিতে প্রধান দুই দলের ভোটপ্রাপ্তিতে সামান্য পার্থক্য থাকলেও আসনপ্রাপ্তিতে ব্যাপক বৈষম্য ছিল, যা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে তা হবে না। আদর্শভিত্তিক ছোট দলগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং বড় দলগুলোকে চাপে রাখবে। এ ক্ষেত্রে জোট হবে নির্বাচনের পরে এবং বড় দলগুলোকে ছোট দলের শর্ত মেনেই জোট করতে হবে।’

ড. তোফায়েল আহমেদ তাঁর ‘সংস্কার সংলাপ’ (সূচনা সূত্র) বইয়ে পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করে এই পদ্ধতি গ্রহণের সুপারিশ করেছেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post