অভিন্ন নদীসমূহের পানিবন্টন ও ভারতের টালবাহানা

পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দ্বন্দ স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশের অবস্থান ভাটির দিকে আর ভারতের অবস্থান উজানে। এদেশের অধিকাংশ নদীই ভারত ও নেপালের বিভিন্ন পাহাড়ে উৎপন্ন হয়ে ভারতের মদ্ধ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

পানি নিয়ে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সংকট শুরু হয় ১৯৫০ এর দশকে। এসময় গঙ্গার অন্যতম শাখানদী হুগলির নাব্যতা রক্ষায় ভারত মুর্শিদাবাদের ফারাক্কায় বাধ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও তৎকালিন পরিবেশবীদরা এবং পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। কারণ গঙ্গায় বাধ দিলে বাংলাদেশ তৎকালিন পুর্ব পাকিস্তান অংশে এ নদী যা পদ্মা নামে পরিচিত তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্বেও ১৯৬১ সালে ভারত বাধ নির্মাণ করতে শুরু করে। 

যদিও পরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু পুর্ব পাকিস্তান ঘিরে অস্থিরতার কারণে এই আলোচনা আর সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের মে মাসে ফারাক্কা পয়েন্টে শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করান।  এই সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না। এ চুক্তির আলোকে অভিন্ন নদীসমুহের সমস্যার সমাধানে গড়ে ওঠে যৌথ নদী কমিশন। 

১৯৭৫ সালে ভারত বাংলাদেশের কাছে মাত্র ১০ দিনের জন্য পরিক্ষামুলকভাবে ৩১০-৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণের অনুমতি নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের কারণে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সুজোগে ভারত নিয়মিত পানি অপসারণ করতে থাকে। ১৯৭৬ সালে মাওলানা ভাসানী ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেন এবং নিজের ৯১ বছর বয়সেও লং মার্চের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ভাসানীর মৃত্যুর পর ভারত পানি অপসারণ অব্যাহত রাখে। 

পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৫ সালে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর সাথে পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে ১৯৮৯ সালের পর আর দীর্ঘ সময় আর কোন চুক্তি না হওয়ায় ভারত ইচ্ছামত পানি অপসারণ করতে থাকে। ১৯৯৩ সালে ভারত মাত্র ১১০০০ কিউসেক পানি সরবরাহ করে, যদিও বাংলাদেশের চাহিদা ৩৫০০০ কিউসেকেরও বেশি। ১৯৯৬ সালে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এইচ ডি দেওবগৌড়ার মদ্ধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ভারত চুক্তি শর্ত ভংগ করে পানি অপসারিত করতে থাকে। 

নিয়মিত পানি অপসারণের কারণে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পদ্মার বিপুল অংশ মরূকরণের মুখোমুখি হয়েছে। 

এদিকে ১৯৯৮ সালে গজলডোবায় তিস্তা বাধ দিয়ে ভারত তিস্তা নদীরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে। তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন কার্জকরী চুক্তি না হওয়ায় ভারত পরিপূর্ণভাবে পানিবঞ্চিত করছে এই নদীটিকে। ফলে এ নদীটি এখন মৃতপ্রায়। 

১৯৯৭ সালে তিস্তা নদীতে প্রায় ৬০০০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। গজলডোবা বাধের কারনে এ পান ক্রমশ কমে ২০১৪ সালে ৭০০ কিউসেকে নেমে আসে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পায় মাত্র ৪০০ কিউসেক। 

পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর একগুয়েমীর কারণে এখন পর্যন্ত এই অববাহিকায় পানি নিয়ে কোন সুরাহা সম্ভব হয়নি। সাবেক আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক থাকলেও দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেও কোন সুরাহা করতে পারেনি তারা। ক্রমশ পানি বঞ্চিত হয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ নদীর উপর নির্ভরশীল উত্তরের জনপদ। তিস্তা সেচ প্রকল্প পুরোপুরি অকার্জকর হয়ে পড়েছে। বিরুপ প্রভাব পড়েছে জলজ জীববৈচিত্রে। স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায় এ নদী প্রায় মাছ শুণ্য। 

শুষ্ক মৌসমে পানি নিয়ে টালবাহানা করলেও বর্ষায় ভারত পানি প্রদানে উদার হয়ে ওঠে ফলে প্রায় প্রতিবছর সৃষ্টি হয় বন্যা। বেশিরভাগ সময় কোন পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বাধ খুলে দেয়ার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এদেশের। ডম্বুর বাধ খুলে দেয়ার কারণে ২০২৪ এর আগষ্টের ভয়াবহ বন্যায় বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশে। 

Post a Comment

Previous Post Next Post